দরদর করে ঘামছিলাম আমি। এসি তো দূরের কথা, নড়বড়ে ফ্যানটাও ঢিমে তালে চলছিলো। যে গতীতে চলছিলো তাতে সেখান থেকে এক ফোটা বাতাস পাবার আশাও বৃথা। তবুও এই নতুন এডভেঞ্চারে আমি এতই মেতে ছিলাম যে কোনো কষ্টই আমার কষ্ট মনে হচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো আমি তো সব জেনেশুনেই এখানে এসেছি। আমি তো এটাই চেয়েছি। নতুন কোনো জীবন। তো একদমই নতুন হোক না কেনো? কোনোই সমস্যা নাই।
রাত দশটার দিকে চলে গেলো ওরা। আমি বিছানাতেই বসে ছিলাম। শুভ্র আমার সামনে এসে বসলো। বললো, কি ভাবছো? এই চালচুলোহীন ভবঘুরের সাথে একটা দিনও কি থাকা যায়? ভাবছো অনেক বড় ভুল হয়ে গেলো তাইনা? আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম, তোমার কষ্ট হবে। তুমি শুনলে না। আমি হাসছিলাম। আমার কিন্তু কষ্ট হচ্ছিলো না বরং মজাই লাগছিলো এই নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ। এক্কেবারে অজানা, অচেনা এই জীবন বা জগৎটাতে ঢুকে যেতে পেরে।
ছোটবেলায় বড় রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যখন ছুটে যেতাম গ্রামে দাদুর বাসায়। তখন দেখতাম রাস্তার ধারে কুড়েঘর বা টিনের এক চালা দোচালা ঘরগুলো, খড়ের গাঁদা বা পুকুরের পাড়ে কাপড় কাচছে মেয়েরা। ঐ জগতটাকে স্বপ্নের জগত মনে হত আমার। কত দিন সে সব লং জার্নিতে আমি সেই সব বাড়ির বাসিন্দা হয়ে স্বপ্নের জগতে চলে যেতাম। ঠিক ওমন নিকানো উঠোনের ছবিতে আঁকা মাটির বা টিনের বাড়িতে মানুষগুলো তখন আমার চোখে ছবিতে আঁকা ছবি হয়ে ভাসতো। এটাও তেমন আমার এক অচেনা জগৎ। ভাঙ্গাচোরা এই চিলেকোঠার ঘরে নতুন এক স্বপ্ন স্বপ্ন জীবনের শুরু। এমন জগৎ আমার একেবারেই অচেনা। এমন জীবন আমার একেবারেই অদেখা। তবুও আমি অখুশি নই। এই জগতে থাকে আমার ভালোবাসার মানুষটি। আমি তার কাছে চলে এসেছি। আজীবন তার জগতে থাকবো বলে।
আমাকে দরদর করে ঘামতে দেখে ও বললো ইশ তোমার তো মনে হয় খুব গরম লাগছে। তুমি হাত মুখ ধুয়ে কাপড় চেইঞ্জ করে ফেলো। আমাকে ও নিয়ে গেলো ছাদের উপর ঐ চিলেকোঠার পাশেই এক রতি এক ছোট্ট ওয়াশরুমে। হঠাৎ স্বপ্নের জগৎ বুঝি নড়ে উঠলো আমার। ভাবছিলাম এখানে কি করে চেইঞ্জ করবো আমি! আমার বিস্ফারিত চেহারা দেখে ও হেসে ফেললো।
- কি ম্যাডাম দেখলেন এবার, কি মানবেতর জীবন আমার। এখনও সময় আছে। ভেবে দেখতে পারেন। আমি তাড়াতাড়ি ফের বাস্তবে ফিরে এলাম। এত সহজে হার মানার পাত্রী আমি না। কাজেই যে জীবন ছেড়ে এসেছি এবং যে জীবনে ঢুকেছি তা থেকে সরে দাঁড়াবো এত সহজে? তা তো হতে পারে না।
হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে বসতে না বসতেই আবার নতুন উপদ্রব। ঠাস করে আইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো। কিন্তু মূহুর্তেই আমাকে অবাক করে দিয়ে জানালা দিয়ে সারা ঘর ভরে উঠলো আলোকিত জ্যোস্নায়। এই অদ্ভুত মায়াময় জ্যোস্না আমার আগে কখনও দেখা হয়নি। আমার বদ্ধ সাউন্ডপ্রুফ রুমের ডাবল গ্লাসের উপরে ভারী পর্দা ভেদ করে কখনও ঢোকেনা কোনো চাঁদের আলো। কিন্তু আজ এই মায়াবী আলোর জ্যোস্না মাখা রাত আর ছাদের কোনে লাগানো হাস্নাহেনার গাছ থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত এই অপার্থীব সুগন্ধ মূহুর্তেই আমাকে নিয়ে গেলো এক অপার্থীব জগতে! এক নিমিষে চিলেকোঠার ঘরটি যেন রুপকথার মত বদলে গিয়ে হয়ে উঠলো স্বর্গীয় সুন্দর!
শুভ্র আমার হাত ধরে বললো, দেখো আজ পূর্নিমা। আকাশে কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চলো ছাদে গিয়ে বসি। আমরা ছাদের এক কোনে গাঁথা সিমেন্টের বেঞ্চে এসে বসলাম। শুভ্র আমার গা ঘেষে আমাকে জড়িয়ে রেখেছিলো ওর এক হাতে। আমি পরম নির্ভরতায় ওর কাঁধে মাথা রাখলাম। চারিদিকে শুনশান। বসন্তের মাতাল হাওয়া বইছিলো। শুভ্র আর হাস্নাহেনার গন্ধে তখন মৌমিতাল পূর্নিমা রাত! আমার বুকের ভেতর এক আশ্চর্য্য উথাল পাথাল। প্রেম জিনিসটা যে আসলেই কি সেই প্রথম বুঝলাম আমি। মনে হচ্ছিলো সেই অপূর্ব ক্ষন যেন কখনও শেষ না হয়। সারাজীবন এভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। আমরা চুপচাপ অনেকক্ষন বসেছিলাম সেই রাতে। সেই আলোকিত অপরূপ জ্যোস্নারাতে ছাদ ঘেষে নীরব সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে ছিলো নারকেল, সুপারী আর দেবদারু গাছেরা। নারকেলের ঝিরঝিরি পাতা থেকে এক অদ্ভূৎ শব্দ আসছিলো। আর শুভ্র বুকে মাথা রেখে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম ওর হৃদপিন্ডের শব্দ। আজ এতগুলো দিন পরেও আমি চোখ বুঝলেই সেই শব্দটাই শুনি।
সত্যি বলতে আমার এই পর্যন্ত জীবনে সেই রাতটির মত সুন্দর রাত আর কখনই ছিলো না। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত জ্যোস্না গায়ে মেখে বসেছিলাম আমরা ছাদে। শুভ্র বলেছিলো, একটা গান শোনাবে? আমি হেসে ফেলেছিলাম ওর কথায়। বলেছিলাম তাহলেই ষোলো কলা পূর্ণ হয় তাই না? ও অবাক হয়ে বলেছিলো, কিসের ষোলো কলা! আমি বলেছিলাম কিসের আবার? বাংলা সিনেমার। অনেক জোরে হেসে উঠেছিলাম আমরা। পাশের দেবদারু বা নারকেল গাছ হতে একটা রাত জাগা পাখি ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটিয়ে উঠেছিলো। সে শব্দে আমি আরও ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম শুভ্রকে। বাংলা সিনেমার দৃশ্যগুলি যেন সেই রাতে সবার অগোচরেই চিত্রায়িত হয়ে গেঁথে রইলো আমার বুকের গভীরে আর সেই বসন্তের রাতের মায়ামাখা জ্যোস্নায়।
আমি গেয়েছিলাম, যেতে যেতে পথে পূর্নিমা রাতে চাঁদ উঠেছিলো গগণে, দেখা হয়েছিলো তোমাতে আমাতে কি যেন কি মহা লগনে? আসলেই সে ছিলো এক মহালগন শুভ্র! তোমার গায়ের গন্ধ, তোমার বুকে মাথা রেখে শোনা তোমার বুকের ধুকপুক আর আকাশ ভেঙ্গে নামা জ্যোস্না সব মিলিয়ে এত সুন্দর স্বর্গীয় প্রেমের দৃশ্য, গন্ধ ভালোবাসা কোনো চিত্রকর পারবেনা তার তুলিতে আঁকতে......
প্রায় ভোর রাতে ঘুমাতে গিয়েছিলাম আমরা। সকালে যখন ঘুম ভাঙলো শুভ্রের একটা হাত তখনও জড়িয়ে আমাকে। জানালা গলে ভোরের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ছিলো ওর পাশ ফেরানো মুখের ওপর। ওকে পৃথিবীর সবচাইতে পবিত্রতম দেবদূতের মত দেখাচ্ছিলো। আমি ওর গালে হাত ছোঁয়ালাম। গভীর ঘুমে আছন্ন তখনও সে...
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০৩